কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের শামলাপুর চেকপোস্টে ৩১ আগস্ট রাতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে চারটি গুলি করেন বাহারছড়া ক্যাম্পের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলি। এর কিছুক্ষণ পরে ঘটনাস্থলে আসা ওসি প্রদীপের কাছে পানি চান গুলিবিদ্ধ সিনহা। তবে পানি না দিয়ে পা দিয়ে সিনহার গলাচেপে ধরেন প্রদীপ। গোয়েন্দা সংস্থার একজন সদস্য এ তথ্য জানিয়েছেন।
গত ৩ জুলাই ‘জাস্ট গো’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ট্রাভেল শো ডকুমেন্টারির শুটিংয়ের জন্য তিনজন সহযোগীসহ কক্সবাজারের নীলিমা রিসোর্টে ওঠেন মেজর অবসরপ্রাপ্ত সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই খবর পৌঁছায় টেকনাফের তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমারের কাছে। তখন থেকেই ওসি প্রদীপ অধিনস্ত পুলিশ সদস্যদের বলেন, ভিডিও পার্টিকে এখান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে, যেকোন মূল্যে।
এরপর থেকেই সিনহাকে নজরদারিতে রাখেন পরিদর্শক লিয়াকত ও এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত। ৩১ জুলাই সকালে একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘বৃক্ষরোপণ’ অনুষ্ঠান শেষে ওসি প্রদীপকে জানানো হয়, মেজর সিনহা রাশেদ প্রাইভেটকার নিয়ে টেকনাফের শামলাপুর পাহাড়ে গেছেন। এ সময় সোর্সের মাধ্যমে বাহারছড়া ক্যাম্পের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলি সিনহার প্রতি নজর রাখতে থাকেন।
শুটিং শেষ করে রাত সাড়ে ৮টায় সিনহা ও তার ভিডিও ধারণের সহযোগী সিফাত পাহাড় থেকে নেমে নিজস্ব প্রাইভেটকারে মেরিন ড্রাইভ করে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দেন। শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে আসার আগে বিজিবি চেকপোস্টে সিনহার গাড়ি তল্লাশির জন্য থামানো হয়। তবে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। রাত ৯টায় সিনহার গাড়ি শামলাপুর চেকপোস্টে আসলে এপিবিএনের একজন সদস্য গাড়িটি থামান। পরিচয় নিশ্চিতের পর তাকে চলে যেতে বলেন। কিন্তু আগে থেকে চেকপোস্টে থাকা ইন্সপেক্টর লিয়াকত মেজর সিনহার গাড়ির বাম পাশে গিয়ে বেরিকেড দেন। পরিচয় জানতে চাইলে মেজর সিনহা ইংরেজিতে নিজের পরিচয় দেন। এ সময় গাড়ির সামনের সিটে থাকা সিফাতকে নামিয়ে মারধর শুরু করেন লিয়াকত। সিনহা এ দৃশ্য দেখে চালকের আসন থেকে বের হয়ে আসেন। এরপরই দূর থেকে সিনহাকে দুটি গুলি করা হয়। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে আবারো দুটি গুলি করা হয়। মোট চারটি গুলির পর মেজর সিনহা রাস্তায় শুয়ে পড়েন। তাৎক্ষণিক ঘটনাটি জানানো হয় ওসি প্রদীপকে। এ সময় প্রদীপ বলেন, আমি না আসা পর্যন্ত তুমি (লিয়াকত) ওখানে থাকো, আমি আসছি।
এর কিছু সময় পরেই ওসি প্রদীপ ঘটনাস্থলে আসেন। প্রদীপ ঘটনাস্থলে এসে সিনহাকে উদ্দেশ্য করে গালিগালাজ করতে থাকেন এবং সিফাতকে নির্যাতন করেন। থানার মুন্সিকে ফোন করে আরো ফোর্স পাঠাতে বলেন প্রদীপ। এর কিছু সময় পরেই ঘটনাস্থলে আরো পুলিশ সদস্য বাড়ানো হয়।
এদিকে চার দফায় ১৫ দিন রিমান্ডে থাকলেও মেজর সিনহা হত্যায় নিজের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার। চতুর্থ দফার রিমান্ড শেষে মঙ্গলবার আদালতে হাজির করা হলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
বুধবার (২ সেপ্টেম্বর) দুপুরের দিকে সিনহা হত্যা মামলার অন্যতম আসামি কক্সবাজারের টেকনাফের বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশের দেখা পেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি। কক্সবাজার জেলা কারা ফটকে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে তদন্ত কমিটি। কক্সবাজার জেলা কারাগারের সুপার মোকাম্মেল হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এই হত্যা মামলার প্রধান আসামি ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলি ও তৃতীয় আসামি এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এই মামলার দ্বিতীয় আসামি প্রদীপ কুমার দাশ। গতকাল বেলা সাড়ে ৩টার দিকে র্যাবের একটি দল প্রদীপকে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে হাজির করে। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে তাকে কারাগারে পাঠোনো হয়।
আত্মসমর্পণের দিন গত ৬ আগস্ট ওসি প্রদীপসহ সাত আসামিকে সাত দিন করে রিমান্ড দেয় আদালত। পরে ২৪ আগস্ট চার দিন, ২৮ আগস্ট তিন দিন ও ৩১ আগস্ট এক দিনসহ মোট ১৫দিনের জন্য ওসি প্রদীপের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত।
আদালতের আদেশ পেয়ে এই ১৫ দিন বিভিন্ন সময়ে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্ত সংস্থা র্যাব। এই মামলায় রোববার ইন্সপেক্টর লিয়াকত ও সোমবার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে মেজর (অব.) সিনহা নিহত হওয়ার ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে দুটি মামলা হয়। একটি মামলায় হয় টেকনাফ থানায়। এই মামলায় সরকারি কাজে বাধা ও গুলিতে নিহত হওয়ার অভিযোগ আনা হয়। সেই মামলার আসামি করা হয় সিফাতকে। আর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে রামু থানায় দায়ের করা মাদক মামলায় আসামি করা হয় শিপ্রা দেবনাথকে।
৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন বাদী হয়ে একই আদালতে টেকনাফ থানার বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী, থানার এসআই নন্দলাল রক্ষিতসহ নয় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। পরের দিন বিকেলে ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকত, এসআই নন্দলাল রক্ষিতসহ সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। একই আদালত র্যাবের পৃথক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকত ও এসআই নন্দলাল রক্ষিতকে সাত দিনের রিমান্ড এবং অপর চার আসামি কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন ও এসআই লিটনকে কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন। অপর দুই আসামি এসআই টুটুল ও মো. মোস্তফা আদালতে হাজির হননি। পুলিশের দাবি, এই নামে জেলা পুলিশে কেউ নেই।
Discussion about this post